মকবুলা পারভীন
গ্রামাঞ্চলে এ দেশের বন্যাকে দুই নামে আখ্যায়িত করা হয়। একটি ‘বউ’ বান অন্যটি ‘বুড়ি’ বান। বউবান হচ্ছে জ্যৈষ্ঠ মাসে পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাতের বান। মোট তিন-চার দিন থেকে চলে যায়। এ যেন বিয়ে হওয়া মেয়ে অর্থাৎ বউয়ের বানের বাপের বাড়ির সফর। দু’চার দিন উঁকি ঝুঁকি দিয়ে চলে যায়। আর বুড়িবান অর্থাৎ বড় বান আসে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে। নদ-নদী দু’কূল ছাপিয়ে আসে যে আসে, যেতে চায় না। যেন স্থবির, অলস সময় কাটিয়ে যায়। তাই আঞ্চলিক মানুষ বানের প্রকৃতিতে খুঁজে নিয়েছে নারী রূপ। নামকরণ করছে ওইভাবে। কতশত বছর ধরে এই নামকরণ কেউ জানে না। তবে সত্যি, বানের প্রকৃতিতে এই রূপের ব্যত্যয় ঘটেনি।
কিছু দিন আগে সিলেট ও উত্তরাঞ্চলের কিছু জেলায় পাহাড়ি ঢলের বিস্তারে ছোট বান হয়ে গেছে। বান ছোট হলেও এর ভোগান্তি কম ছিল না। সেটি থেকে নিস্তার না পেতে পেতেই আষাঢ়ের শুরুতেই হঠাৎ ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। কিছুদিন আগে পত্রিকার হেডলাইন হয়েছে, ‘সিলেট বিভাগ পানির নিচে, সুনামগঞ্জ বিচ্ছিন্ন, ৯০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত, মোবাইল নেটওয়ার্ক বিঘ্ন, সিলেটে বিদ্যুৎকেন্দ্র তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা, বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন, ওসমানী বিমানবন্দর বন্ধ। এ দিকে উত্তরাঞ্চলে হু হু করে নদ-নদীর পানি বাড়ছে। সিলেটে উদ্ধারকাজে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের পাশে। আসাম ও মেঘালয় থেকে সিলেটের ভূমি নিচু। গত কয়েক দিনে কয়েক হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে ভারতের দিক থেকে পানিপ্রবাহ সরাসরি বাংলাদেশের সিলেটে পতিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে প্রবল বন্যার। এ দিকে ওই অঞ্চলেও প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এই দুইয়ে সৃষ্ট বন্যা আঘাত হেনে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। এ বন্যা কিছুটা হলেও সিলেট অঞ্চলে প্রকৃতিদত্ত পাহাড়গুলো কিছুটা সামলাতে পারত। কিন্তু সিলেট অঞ্চলে বেপরোয়া পাহাড় কাটায় ঢলের পানি প্রবেশে কোনো বাধাই আর নেই। আর কোনো উপায়ও খোঁজা হয়নি বা তৈরি করা হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে কথাটা খেলো মনে হলেও বলতে হয়, আমরা নির্বিচারে প্রকৃতিকে নিয়ে খেলা করি।
কোনো আইন একশ্রেণীর দুর্বৃত্তকে থামাতে পারে না, তারা জাল ফসকে বেরিয়ে যায়। তাই পৃথিবীর স্রষ্টা হাসেন। মানুষ বোঝে না, যা তারা ধ্বংস করে তা সৃষ্টি করার মুরোদ তাদের নেই। ধ্বংস ধ্বংসই ডেকে আনে। ধ্বংসে সৃষ্টি ফিরে আসে না। বন্যাকবলিত সিলেট অঞ্চলে বিদ্যুৎ, খাবার ও রান্নার পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি তো হিসাবের মধ্যেই পড়ে না। এ দিকে বন্যায় চলাচলের জন্য মুখ্য বাহন নৌকারও ঘাটতি আছে। সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে, এটা আশার কথা। অবস্থা ভালোর দিকে যাক- এটি কাম্য।
এ দিকে উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীগুলোতে পানি বাড়ছে। বন্যা ধেয়ে আসছে। নদ-নদীতে ভাঙন বন্যার স্বাভাবিক রূপ। এতে নতুন করে বহু মানুষের জমিজমা আর ঘরবাড়ি তলিয়ে ভাঙনকবলিত হয়ে মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। প্রতি বছরই এই অবস্থা হয়। প্রতি বছরই নিঃস্বের তালিকায় যুক্ত হয় জমিজমার মালিকদের নাম। এটা তো গেল বন্যায় ক্ষতির কথা বন্যার সময়। মানুষের হালহকিকত কেমন হয়, তা এাণ বিতরণে গিয়ে বা সেলফি তুলে বুঝানো সম্ভব নয়। ঘরবাড়ি ভেসে যাওয়া, মানুষ, সংসার, গবাদিপশু, ফসল সব একটা বিপর্যয়কর অবস্থা। সরকারের বিভিন্ন বাহিনী, প্রশাসন, স্বেচ্ছাসেবকরা এই সময় বহু কষ্ট করে ত্রাণ দান করেন, বন্যার্তদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা, চিকিৎসা ব্যবস্থা করেন যা উপকারী।
আসলে চরাঞ্চল বা নিম্নাঞ্চলের মানুষের জন্য টেকসই কোনো উন্নয়ন প্রকল্প সেভাবে সফল হচ্ছে না বলে বন্যাঞ্চলে দুর্ভোগ চলমান থাকছে। বন্যাদুর্গত এলাকাবাসী ও গবাদিপশু রক্ষায় সরকার বিভিন্ন সময় প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যেমন বন্যাকালীন আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন।
এই ধরনের আশ্রয়কেন্দ্র হওয়া উচিত নদী বা ভাঙনকবলিত এলাকা থেকে দূরে কোনো উঁচু স্থানে, যেখানে যুগে যুগে বন্যা হানা দেয়নি। এ জন্য জমির মাটি পরীক্ষা করেই আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করার কথা। প্রতি বছরই দেখা যায়, বহু অর্থ খরচ করা এ ধরনের আশ্রয়কেন্দ্র ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে বা ভাঙনের কবলে। তাহলে লাভ কী? মোট কথা, এক দিকে সরকারি অর্থের অপচয়, অন্য দিকে বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ। শেষ পর্যন্ত বন্যাকবলিত মানুষগুলোকে দুর্ভোগে আশ্রয় নিতে হয় দূরের আত্মীয় বাড়িতে বা সড়কের পাশে। তাই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো স্থাপনের ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টি ও বিবেচনাকে প্রাধান্য দেয়াই শ্রেয়।
বাংলাদেশ ভাটির দেশ। উজান থেকে আসা বৃষ্টির পানি, পাহাড়ি ঢল, ভারতের ছেড়ে দেয়া পানি, নদীর বন্যা সব কিছুর পরিণতিই বন্যা। এ বন্যা রুখার অবস্থা নেই বাংলাদেশের। তাই বন্যা মোকাবেলার পদক্ষেপই নিতে হবে ভালোভাবে। একটি থানা প্লাবিত হলে কতটি পরিবার ভুক্তভোগী হবে তার লিস্ট থাকতে হবে থানাপর্যায়ে। সে অনুযায়ী তাদের উদ্ধার, খাদ্য, স্বাস্থ্যরক্ষা, চিকিৎসা ব্যয়, পানি, জ্বালানি আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সেটি বন্যা নয়, আগাম প্রস্তুতি রাখতে হবে। শিশুদের নিরাপত্তাব্যবস্থা দেখতে হবে। এইভাবে ছোট ছোট ভাগে আগাম ব্যবস্থা নিয়ে রাখলে বন্যায় সাময়িক নিরাপত্তাব্যবস্থা নিতে কষ্ট হবে না।
সাধারণত দেখা যায়, বন্যায় ত্রাণ পৌঁছাতে দেরি হয় আর মানুষের বেকায়দা পরিস্থিতি বাড়তে থাকে। ত্রাণ নিয়ে হরিলুটের কাণ্ডকারবারও এ দেশে হয়। কে কোন দলের সমর্থক তারও লিস্ট হয় আর মুখ চিনে ত্রাণ দেয়া হয়। কেউ ভাবে না, দুর্গত মানুষের আলাদা কোনো পরিচয় নেই। ক্ষুধা-পানি কষ্ট, শারীরিক-মানসিক কষ্ট সবারই এক, দুর্গত মানুষ সবাই সমান। এ কথা মনে করে জনপ্রতিনিধিদেরই নির্দেশ দেয়া উচিত, ‘ত্রাণ সবাই পাবে, এতে ভেদাভেদ যেন না করা হয়।’
আমাদের দেশে একশ্রেণীর মানুষ আছে যারা প্রভাবশালীদের চামচামি করতে গিয়ে তাদের ‘কানপড়া’ দেয়। ‘কানপড়া’ দিয়ে মানুষ সম্পর্কে প্রভাবশালীকে প্রভাবিত করে যাতে বিপক্ষ সম্পর্কে প্রভাবশালী খারাপ পদক্ষেপ নেয়। এটি ‘পলিটিক্স’। এটি অফিস-আদালতে, কর্মক্ষেত্রসহ সমাজে খুব ক্রিয়াশীল। এর ফলে প্রাপ্য থেকে অনেকে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।
তবে দেশে শিক্ষিত তরুণসমাজ বন্যা, মহামারী, অগ্নিকাণ্ডে আত্মবল নিয়ে এগিয়ে আসে। গত মহামারীর সময় স্বেচ্ছাসেবক হয়ে অনেক তরুণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থ জোগাড় করে তা দুর্গতদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। আবার প্রতিবার বন্যার সময় স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির শিক্ষার্থীরা টিম গঠন করে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছে দিয়ে সুমহান কাজ করে গেছে। কেউ কেউ সাঁতার না জেনে নৌকায় গিয়ে নৌকাডুবিতে প্রাণও বিসর্জন দিয়েছে। তবে সাঁতার না জানা ছেলেদের এসব বিপজ্জনক পানিপথে না যাওয়া ও না পাঠানোর সতর্কতা মেনে চলাই যুক্তিযুক্ত।
এবারের সিলেটে ও উত্তরাঞ্চলের বন্যায় তরুণ শক্তি ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুর্গত মানুষের সাহায্যে। এরা দল-তাল বোঝে না। এদের বুকভরা সাহস ও মানবিকতা। এরা মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত। তরুণ শক্তিকে আমরা জানাই সহস্র সালাম। এদের পুরস্কৃত করা উচিত।