জনমুখে বহুল প্রচারিত ও প্রমাণিত বঙ্গবন্ধু মুজিবের দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেই ঐতিহাসিক উক্তি, “স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন”। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিক্রমায় যাহা শতভাগ সত্যবাণী হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।বাঙ্গালী জাতির অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল স্বাধীন সার্বভৌম একটি ভূখন্ড। একাত্তর সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু মুজিবের নেতৃত্বে অর্জন করে কাঙ্খিত সে স্বাধীনতা।পচাত্তরে স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে হ্ত্যার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও পরাজিত গোষ্ঠী খামচে ধরে সে স্বাধীনতা।পরে বিভিন্ন নাটকীয়তায় জেনারেল জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর তার ছত্রছায়ায় স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠী পুনর্বাসিত হয়ে আসে।মাথাচাড়া দিয়ে উঠে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি।দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে ইতিহাস বিকৃতি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উল্টো ভাবে উপস্থাপন শুরু হয় । ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে সৃষ্টি হয় মনস্তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি। স্বৈরাচারের সাথে ক্ষমতার অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠী আঘাত করে বাঙালী জাতির কৃষ্টি সংস্কৃতি এবং সামাজিক ঐতিহ্যের ধারক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপর ।কিন্ত ইতিহাসের প্রকৃত সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায় না ।দেশের সেই দূর্যোগ সময়ে রুখে দাড়ায় প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক গোষ্ঠী।দানা বাঁধে মৌলবাদী ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন। মাঠে নামে ছাত্র জনতা।গর্জে উঠে রাজপথ “একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেক বার””সামরিক স্বৈরাচার, ধ্বংস হোক নিপাত যাক” “স্বাধীনতার শত্রুরা হুশিয়ার সাবধান”। আন্দোলন দমনে স্বৈরশাহী পুলিশ লেলিয়ে দেয়। শুরু হয় রাজপথ দখল নিয়ে ঈগল বেজী খেলা । আন্দোলনে অনেক ছাত্র জনতা শাহাদাত বরণ করে। অনেক নেতা কর্মী হত্যার সম্মুখীন হয়।জামাত শিবির দা চাপাতি দিয়ে বহু নেতাকর্মীদের কুপিয়ে জখম, অঙ্গহানি সহ রগ কর্তনে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়। রগকাটা,হাতকাটা, পা হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে অনেকে আজ অবধি । অনেক পরিবার তার কলেজ পড়ুয়া সন্তান হারায়। হারিয়েছে আপনজন। ।জোট সরকারের সময় আওয়ামী রাজনীতির নেতাকর্মীদের উপর চলে নির্মম অত্যাচার।স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার পক্ষের নেতা কর্মীদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হবে এমন হবার ছিল না।কথা ছিল না বিএনপি জামাতের হাতে নিগৃহীত হওয়া।কিন্তু তাই হয়েছে।স্বৈরশাসকের কূটকৌশলে শুরু হয় নেতাদের চরিত্র হরণ। রাজনীতিতে দলবদল, আর্দশ বদল, টাকায় নেতা বিক্রি হওয়ার কারণে রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের অনিহা এসে যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ক্ষমতা দখল করে জেনারেল জিয়ার কুখ্যাত তত্ত্ব ছিল, “রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি করা কঠিন করে দেয়া”।পরে দেখা গেল সত্যি সত্যিই তাই হয়েছে। ভুল বুঝাবুঝি, অবিশ্বাস,প্রতিহিংসা ছড়িয়ে রাজনীতির স্বচ্ছতাকে কলুষিত করা, সন্ত্রাস, হত্যা, দখলবাণিজ্য, বিচার বাণিজ্য, থানার দালালী রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে যায়। নীতি আদর্শের চর্চা, ধারণ, পাঠ বিমুখ হয়ে পড়ে নেতাকর্মী। ফলে অপরাজনীতি সভ্যসমাজ বিনির্মাণে প্রতিবন্ধক হয়ে যায়। বিজ্ঞ রাজনীতিক মহলের অভিমত, জিয়ার সেই কুখ্যাত তত্ত্বের রাজনীতির খেলা নিয়ে আসছিল, তার ধারাবাহিক প্রতিফলন এখনো দেখা যাচ্ছে । কিন্তু এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধু আদর্শের সংগঠনকে।
গত কয়েক দিন আগে কবি মানিক বৈরাগীর একটি এফ বি স্টাটাস পড়ে খুবই মর্মাহত হলো আমার মতো অনেকে।তিনি ঢাকায় গিয়েছিল চিকিৎসার জন্য ।পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে চিকিৎসার খরচ যোগাঢ করেন তিনি। বিএনপি, জামাত শিবির কতৃক তিনি নির্যাতনের স্বীকার বারবার। উচ্চ শিক্ষা নিতে তার পরিবার পাঠিয়ে ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে দিবালোকে শিবির কর্মীরা তাকে দা কুড়ালে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলে রাখে ক্যাম্পাসে। পায়ের গুড়া কাটে।বিএনপি জামাত জোট সরকারের সময় বারবার তাকে গ্রেফতার করা হয়, থানায় নিয়ে রিমান্ডের নামে মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলে।কবির অপরাধ তিনি বঙ্গবন্ধু আদর্শের রাজনীতি করেন,মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, স্বৈরাচারী সরকার বিরোধী আপোষহীন নেতা। ফলে হামলা মামলা হয় বারবার। যার ফলে চিরস্থায়ী পঙ্গুত্বের ভার এখনো বয়ে যাচ্ছেন তিনি। সেই চিকিৎসা নিতে তিনি ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েল যান।কক্সবাজার ফিরে এসে তিনি সেই আবেগঘন স্টাটাসে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রতিবন্ধীদের জন্য হাসপাতালে আলাদা কাউন্টার করার আবেদন জানান। যেন পরীক্ষা নিরীক্ষা কিংবা টাকা জমা করানোর সময় লাইনে দীর্ঘ সময় না দাড়াঁবার হয়। জোট সরকার সময়ের নির্যাতনে তিনি স্বাভাবিক চলাফেরার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন । ওয়ার্কিং স্টিকে ভর করে চলাফেরা করেন, প্রতিবন্ধীদের মতো।তাই তিনি নিজেকে প্রতিবন্ধী ভাবতে থাকেন। তাই প্রতিবন্ধীদের সুবিধার্থে হাসপাতালের কাছে আলাদা কাউন্টারের কথা বলেন।সচেতন সমাজের মতে কবি মানিক বৈরাগীর এই স্ট্যাটাস রাজনীতির জন্য এক সবক । তিনি নিজেকে প্রতিবন্ধী মনে করা মানে, প্রগতিশীল কর্মীদের উপর হামলার তীব্র আর্তনাদ এবং আত্মচিত্কারের প্রতিধ্বনি ।চকরিয়া মাতামুহুরি নদী পাড়ের সন্তান, “মানিক তুমি প্রতিবন্ধী ছিলে না।চলনে-বলনে মেধাবী একজন লড়াকু রাজনৈতিক কর্মী, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ছিল তোমার সরব উপস্থিতি। ক্লাস নাইনে পড়াকালীন সময়ে তুমি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মিশিলের সৈনিক। মেধাবী ছাত্র।অবিভক্ত চকরিয়া উপজেলা ছাত্র লীগের সভাপতি ছিলে তুমি।তুমি কবি এবং লেখক।যার ধারাবাহিকতায় তুমি আজ স্বনামধন্য পাঠক প্রিয় কবি এবং লেখক।পঙ্গুত্ব তোমাকে থামাতে পারে নাই। বিশানায় শুয়ে লিখে যাচ্ছ কবিতায় প্রগতির কথা, করে যাচ্ছ বঙ্গবন্ধু চর্চা”। বঙ্গবন্ধুর এনে দেয়া স্বাধীনতা রক্ষায় রাজপথের সাহসী বীর সৈনিকদের অনেকের সাথে কবি মানিক বৈরাগী একটি উদাহরণ মাত্র।যেমন কক্সবাজার সদরে শফিউল্লাহ আনসারী,ডালিম বড়ুয়া, বৃহত্তর চকরিয়ায় উপজেলার চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাইদী,চকরিয়া পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহেদুল ইসলাম লিটু,জাবেদ পুতুল,মিজানুর রহমান কাকার জাফর আলম সহ আরো অনেক। হত্যার স্বীকার হয় বি এম চর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আলম।দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আরো অনেক মেধাবী রাজনৈতিক কর্মী পঙ্গুত্বের বোঝা নিয়ে দিনাতিপাত করছে। অনেকে পাচ্ছে না চিকিৎসা, ঔষধ, স্বাভাবিক জীবনযাপন।অথচ এই ত্যাগী তৃনমুল কর্মীদের আন্দোলনের ফসল বর্তমান সরকার ক্ষমতায়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে চকরিয়ার রাজপথে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় দৌলত খান ।তার এবং পরিবারের কথা কারও মনে আছে বলে মনে হয় না। এরকম অনেক নেতাকর্মীদের সরব আন্দোলন এবং রক্তের সিড়ি বেড়েই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় দল আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায়। কিন্তু রাজনীতির ভিতর পলিটিক্স এর কারণে ত্যাগী নেতাকর্মীরা ইতিহাসের আড়াল হয়ে যাচ্ছে। ধান্দাবাজ সুবিধাবাদীদের হাতে নেতৃত্ব চলে যাওয়ার
কারণে এবং তাদেরই উম্মুক্ত খড়গ সবসময়েই আদর্শিক ত্যাগী নেতাকর্মীদের উপর যায়।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন। রাজনৈতিক বিশারদদের অভিমত,মহান স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু আদর্শ সমুন্নত রাখার লড়াইয়ে নির্যাতনের স্বীকার কর্মীদের দায়িত্ব নিতে বর্তমান সরকার দায় এড়াতে পারে না।কবি মানিক বৈরাগী বলেন,সাংসদ জাফর আলম বিএ (অনার্স)এম এ সাহেব তার চিকিৎসা নিতে যাওয়ার খবর শুনে ঢাকা যাওয়ার বিমান টিকিট এবং হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করেন।তাই কবি মানিক বৈরাগী মাননীয় সাংসদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে মুক্তিযোদ্ধারা যোগ্য সন্মান থেকে বঞ্চিত হয়।অনেক জায়গায় অপমান অবহেলিত হয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাইতেন না ।অনেক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন নির্বাহ করে।কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরোচিত সন্মানে সন্মানিত করেন। তাদের এবং তাদের পরিবারকে সর্বোচ্চ সহায়তা প্রদান করেন।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন, যারা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক দের বিরুদ্ধে লড়াই করে গনতন্ত্র এবং অধিকার সুসংহত করার আন্দোলনের শামিল তারাও যোদ্ধা।তাঁরা প্রত্যক্ষ সিপাহী।যতদিন দেশ থাকবে ততদিন দেশপ্রেমিক নাগরিকদের এই আন্দোলনের সাথে থাকতে হবে। তাই স্বৈরাচার সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছে, যারা আহত তাদের সন্মানিত করা রাষ্টীয় দায়িত্ব। আর যারা পঙ্গু হয়ে আছে, সরকারের সহযোগিতা পাওয়া তাদের অধিকার। মুক্তিযোদ্ধারা যেমন দেশের সূর্য সন্তান তেমনি সাম্প্রদায়িকতা , মৌলবাদ সহ দেশী-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্রে যারা সব সময় মাঠে থাকে তাঁরা ও জাতীয় বীর। এরা দেশ, মাটি এবং দেশের মানুষের ভালবাসার তাড়নায় দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সৃষ্টি হয়ে থাকে।তাই এদের অবদানকে স্বীকার না করা হলে কবি মানিক বৈরাগীর মতো সবাই নিজেকে প্রতিবন্ধী ভাববে। পরিক্ষিত নেতাকর্মীরা হারিয়ে যাবে। হাইব্রিড সুবিধা বাদী গোষ্ঠী কৌশলে এদের কোনঠাসা করে রাখছে। তাই রাজনীতির স্বার্থে পলিটিক্স থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ভবিষ্যতে যে কোন অনাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না। স্বাধীনতা রক্ষা কবচ হিসাবে তাঁরাই অতন্দ্র প্রহরী হয়ে থাকবে।
জয় বাংলা।
————————–
বদরুল ইসলাম বাদল
কলামিস্ট ও সমাজকর্মী
সদস্য, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি
সাবেক ছাত্রনেতা