বদরুল ইসলাম বাদল
—————————–
সমাজ পরিবর্তনের দর্শন নিয়ে অনেক মানুষ পৃথিবীতে নানামুখী কাজ করেছেন। তাঁরা বুঝাতে চেষ্টা করেন,এই পৃথিবী আমার, আপনার, সবার। সকল মানুষের অধিকার নিয়ে নিরাপদ বসবাসের। তবে মানুষই নিজেদের স্বার্থে গোত্রে গোত্রে এবং জাতিতে বিভক্তি ও বৈষম্য নিয়ে আসে। একই রক্তের মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করে ,সৃষ্টি করে জাতিভেদ, বর্ণভেদ এবং বিভিন্ন ফেতনা । ফলে মানুষের মাঝে ছড়ায় পরস্পর পরস্পরের প্রতি ঘৃণা, ঝগড়া ফেসাদ, দাঙ্গা হাঙ্গামা, যুদ্ধ মহাযুদ্ধ প্রভৃতি। আর এই সব বিভেদ দুর করতে চেষ্টা চালিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন অনেক মহান পুরুষ। মার্টিন লুথার, নেলসন মেন্ডেলা,আব্রাহাম লিংকন ,মহাত্মা গান্ধী সহ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্যতম।তবে পরিতাপের বিষয় যে,এসব নেতাদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে নির্মম হত্যার স্বীকার হয় স্বগোত্রীয়দেরই হাতে।
আমেরিকায় এমন সময় ছিল যে, কালো চামড়ার মানুষের কোন অধিকার ছিল না। শেতাঙ্গদের সাথে কৃষ্ণ বর্ণের মানুষের মিলামেশা করা যেত না।। একসাথে হোটেলে খাবার খেতে পারতো না।সাদা রংয়ের মানুষ গাড়িতে উঠলে কৃষ্ণদের সিট ছেড়ে দিতে হতো।,রাষ্ট্রীয় সুবিধা হতে বঞ্চিত থাকতো কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ ।এই বৈষম্য নিয়ে আমেরিকায় প্রথম আন্দোলন শুরু করেন সমাজকর্মী মার্টিন লুথার। তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের অর্থনৈতিক মুক্তি ও চাকরি সহ সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার নিয়ে দাবি তুলেন।তেমনই দাবি আদায় নিয়ে এক সমাবেশে বক্তৃতারত অবস্থায় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।তবে মার্টিন লুথারের দেখানো পথ ধরেই পৃথিবীতে কালো চামড়ার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কাজের ক্ষেত্রে, স্কুল কলেজে, অফিস আদালতে কালোদের অধিকার আইনি সৃকৃতি পায়। যার ধারাবাহিকতায় কৃষ্ণাঙ্গ বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ হয়।
দাস বেচাকেনা নিয়ে অমানবিক জঘন্য ব্যবসার প্রচলন ছিল পৃথিবীতে।দাসত্ব বিলুপ্তি নিয়ে চার বছর গৃহযুদ্ধ চলে আমেরিকায়।রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধজয়ের পর আইন করে দাসদের মুক্তির আইন করেছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন।কিন্তু আইন স্বাক্ষরের ষষ্ঠ দিনের মাথায় আততায়ীর হাতে নিহত হন তিনি।
অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তা মহাত্না গান্ধী।যিনি ভারতীয় স্বাধীনতার পুরোধা। হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের ঐক্য নিয়ে যিনি আমরণ লড়াই করেন।তাঁর মহত্ আদর্শের জন্য তিনি পৃথিবীতে এখনো সকলের কাছে পূজনীয় এক প্রবাদ পুরুষ। ১৯৪৮ সালে সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনায় যাবার পথে নির্মম ভাবে হত্যা করে হিন্দুত্ববাদী নাথুরাম গডস। এভাবে মানুষে মানুষে সমঝোতা, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারাই এগিয়ে আসে তাদের অনেকেই অকালে প্রাণ হারিয়েছে ।কিন্তু হত্যাকারী গোষ্ঠীর পরিচয় টুকু ব্যক্তিপরিচয়ে চিহ্নিত করা হলেও আসলে কি তাই?কেন এসব হত্যা করা ? সাধারণ মানুষের হয়ে কথা বললে হত্যার স্বীকার হতে হয় কেন?সমাজ বিশ্লেষকদের অভিমত যে, হত্যায় জড়িতদের ব্যক্তি পরিচয় সনাক্ত করা হলেও মূলত এরা মূখ্য নায়ক নয়।এদের শুধু ব্যবহার করা হয় মাত্র ।কারণ ব্যবহারকারী কোন ব্যক্তি কিংবা কোন একক শক্তি নয়। পৃথিবীর সম্পদ ভোগ করতে কতিপয় মানুষের মিলিত তাত্ত্বিক গোষ্ঠী। মানুষকে চাপিয়ে রেখে, দাবিয়ে রেখে, শ্রেণী বিভক্ত করে নিজের স্বার্থ সংরক্ষণই আসল লক্ষ্য ।এই শক্তি কখনো সামন্তবাদ,কখনো উপনিবেশবাদ,নয়া উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ,আবার কখনো ধর্মীয় মতবাদ বা সামরিক শাসকের নাম ধারণ করে । পৃথিবীর দেশে দেশে ভিন্ন নামে ভিন্ন পরিচয়ে আবির্ভাব হয়ে সম্পদ কব্জা করে,লুঠেরাদের প্রতিনিধিত্ব করে ।সাধারণ মানুষদের ঠকায়।স্বার্থ রক্ষা নিয়ে কখনো স্বাধীনতার পক্ষ কিংবা কখনো বিপক্ষে গিয়ে রাজনীতিকে ব্যবহার করে। যা বিশ্বে অসন্তোষের মূল কারণ। তেমনিভাবে বঙ্গবন্ধু মুজিব সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টির দায়ীদের চিহ্নিত করা নিয়ে অন্যান্যদের চেয়ে একদাপ এগিয়ে গিয়ে আরো স্পষ্ট করেন “শোষক” হিসাবে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন।সম্মেলনের আয়োজক ছিলেন আলজেরিয়া।উপস্থিত ছিল ৯২ দেশের রাষ্ট্র প্রধান কিংবা তাদের প্রতিনিধি। সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বিশ্বনেতাদের সামনে বিশ্ব পরিস্থিতি তুলে ধরে তাঁর ভাষণে বলেন,” বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত, শোষক এবং শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে”।বিশ্বের
অনেক শক্তিধর বাঘা বাঘা নেতাদের সামনে সদ্য স্বাধীন দরিদ্র মানুষের একজন নেতার এমন কথায় চমকে উঠে সম্মেলনে উপস্থিতি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষ হতেই সম্মেলনে উপস্থিত কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ” তুমি আজ যে ভাষণ দিলে,এখন থেকে সাবধান থেকো।আজ থেকে তোমাকে হত্যার জন্য একটি বুলেট তোমার পিছু নিয়েছে”।বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে বুঝাতে চেয়েছিলেন সর্বহারা শোষিত শ্রেণির মানুষের পক্ষে কথা বলতে যাওয়াটা বড়ই বিপদের।তিনি নিজেও অসংখ্যবার এমন সমস্যার স্বীকার । তাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা নিয়ে আশঙ্কা করেন তিনি । ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বিশ্ব ফিদেল কাস্ত্রোর সেই শঙ্কার বাস্তব রূপ দেখে ।প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন ১৯৭৩ সালের আলজেরিয়া জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী।তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন,এই সম্মেলন চলাকালীন উপস্থিত নেতাদের মাঝে একবার বড় ঝামেলা লেগে যায়। আমেরিকা বিরোধী কথা বলায় তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট হাবিব বুর্গিবা রেগে যান।তিনি বলেন, “আমরা নিরপেক্ষ টিক আছে,কিন্তু আমেরিকা ও একটা পক্ষ”। এই নিয়ে তো বিশাল গন্ডগোল। বঙ্গবন্ধু এই হট্টগোলে তার স্বভাব সুলভ বজ্রকন্ঠে দাড়িঁয়ে বলেন,”আমরা দুই পক্ষ নই। আমরা সর্বহারার পক্ষে”। উপস্থিত বিশ্বনেতৃবৃন্দ হাততালি দিয়ে তাকে সমর্থন করে।
পৃথিবী আর কত শোক বহন করবে? আর কত দেখবে হত্যার রাজনীতি ? সম্পদের ভোগ নিয়ে তৈরি দ্বন্দ্বে আর কত প্রাণ দেবে মানুষ?।জন্মের অধিকার নিয়ে পৃথিবী সবার। কিন্ত সম্পদের ভোগ নিয়ে মানুষের তৈরী শ্রেণী বিভক্তি। ধনী এবং অভিজাত শ্রেণির মানুষেরা ঘৃণা বর্ষণ করছে বিত্তহীন মানুষদের প্রতি।তাতে শোষিত বঞ্চিত মানুষের আহাজারিতে ভারী হচ্ছে পৃথিবীর আকাশ। খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছে দরিদ্র মানুষ। অপরদিকে ধনী হচ্ছে আরও ধনী।আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিপীড়িত জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারছে না।কারণ এই পদ্ধতিকে অনেক সমাজবিজ্ঞানী ব্যাখা করতে গিয়ে উল্লেখ করেন যে ,” রাষ্ট্র হচ্ছে শ্রেণী বিভক্ত সমাজে শ্রেণি শোষণ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতিয়ার। ইতিহাসে বিভিন্ন ধরনের শোষণমূলক রাষ্ট্র দেখা যায়।আমাদের দেশ প্রজাতান্ত্রিক পদ্ধতির হলেও এ ধরনের রাষ্ট্রের মূলকথা হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে আধিপত্যশীল শ্রেণির একনায়কত্ব”।বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানের সমস্ত সম্পদের মালিক ছিল বাইশ পরিবার খ্যাত কতিপয় গোষ্ঠীর হাতে।তাঁরাই শোষণের নিমিত্তে নিয়ন্ত্রণ করতো সব কিছু। বঙ্গবন্ধু বৃটিশ এবং পাকিস্তানের শাসন নিজ চোখে দেখেছেন।তিনি শোষিত শ্রেণির আর্তচিৎকার দেখেছেন। তাই তাঁর সংগ্রামমুখর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পুরোটা জুড়েই শোষিত মানুষের পক্ষে হয়ে লড়াই করা।কিন্তু স্বাধীনতার পর তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য সফল করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়।কারণ দীর্ঘদিন উপনিবেশ শাসন থেকে মুক্তি হলেও আমাদের সমাজের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতি। গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটের অধিকার পেলেও সামন্ত মানষিক চরিত্রের মানুষের হাতেই শাসন ভার থেকে যায়।আব্রাহাম লিংকনের সংজ্ঞায় গনতন্ত্রের ব্যাখায় , “গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য” হলেও এই পদ্ধতিতে কৌশলে শোষক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব রয়ে যায় সরকারে। তাই বঙ্গবন্ধু
বুঝতে পারেন যে শোষিত শ্রেণির মানুষের মুক্তির জন্য শোষিতের গনতন্ত্র কায়েমই জরুরী। এই বৈপ্লবিক কর্মসূচির ঘোষণার পর পরই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। ফলে শোষিতের গনতন্ত্র হিমঘরে আটকা পড়ে।
বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন শান্তিময় বিশ্বের। যেখানে থাকবে না দারিদ্র্য সংঘাত,অবিচার বর্ণবৈষম্য,সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ। তিনি বিশ্ব উপনিবেশবাদের বিলুপ্তি দাবি করেছিলেন। ইসরায়েল কতৃক অন্যায়ভাবে জোরপূর্বক আরব ভূখণ্ড ফিরিয়ে দেবার দাবী জানান।ফিলিস্তিনের মুসলমানদের পক্ষে আওয়াজ তুলে তাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবী করেন।বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।যেখানে গ্রাম থেকে শহরে ছিন্নমূল ভিত্তিহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। স্বাধীনতার সুফল তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছাতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন তিনি। কিন্তু এই হত্যাকান্ডের দৃশ্যপটে কতিপয় বিপদগামী মানুষের নাম আসলে ও মুলত বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য আন্তর্জাতিক শোষক শ্রেণির বহুব্রীহি সম্প্রদায়ের অনুগামীরাই দায়ী। তৃতীয় বিশ্বের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের কন্ঠ হয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তখনই তাকে হত্যা করা হয়।তাই বলা যেতে পারে, বঙ্গবন্ধুর বুকে গুলি চালানোর জন্য অন করা বন্দুকের ট্রিগারের গুলি বেরিয়ে এখনো ঝাঁজরা হচ্ছে বিশ্বমানবতা, রক্তাক্ত হচ্ছে শোষিত মানুষ। করোনা ভাইরাসের মত রূপ বদলায়ে, উপসর্গ বদলায়ে ছোবল মারছে পৃথিবী জোড়া। তাই শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য দরকার একজন বঙ্গবন্ধু।যাতে কায়েম হবে শোষিতের গনতন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর রক্তে মুক্তি পাবে সর্বহারা সুবিধা বঞ্চিত মানুষ।
জয় বাংলা।
—————-
লেখক –বদরুল ইসলাম বাদল
কলামিস্ট ও সাবেক ছাত্রনেতা।
সদস্য, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি