• শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:০৫ পূর্বাহ্ন
  • [gtranslate]

সহেনা যাতনা, মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভোগে মাতামুহুরিবাসী

চকরিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি: / ২৭৩ Time View
আপডেট : মঙ্গলবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

বদরুল ইসলাম বাদল
বৃষ্টি ছাড়া এই মৌসুমের বর্যা  নিরবে শেষ হল।
ষড়ঋতুর এই দেশে  বৃষ্টির পানিতে ফসল ফলায় কৃষক ।কিন্তু এই মৌসুমে  কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি আসে নাই।অনেক   মৌসুমে বর্ষাকালে  ভারী বৃষ্টিপাতে   ঢোবে যায় লোকালয়, বীজতলা,রোপন করা ধানের গাছ,দেখা যায় বন্যা।রাস্তার উপর পানিতে নৌকা চলে।তবে এই বর্ষার শুরুতে  কিছুটা বৃষ্টি হলেও এখন শুধু আকাশে মেঘরা খেলা করে , বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে না।তাই জনপদের  ঘরে ঘরে বৃষ্টির জন্য হাহাকার করছে  মানুষ। আহাজারি করছে।সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছে প্রতিটি ধর্মের মানুষেরা।  গ্রামে দল বেধে মানুষ বৃষ্টির জন্য কান্না করছে,বৃষ্টির নামাজ আদায় করছে।  অনাবৃষ্টিতে ফসলের  জমি শুকিয়ে গেছে। ফাটল ধরেছে মাটি।ধানের চারা পানির অভাবে মরণদশা। এই পরিস্থিতিতে কৃষকদের হ্নদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ধান মরে গেলে, সংসারে নেমে আসবে অভাব।বন্ধ হয়ে যাবে ছেলেমেয়ে দের ভরণপোষণ, লেখাপড়া। কারণ চকরিয়া উপজেলাধীন  উপকূলীয় সাত ইউনিয়নবাসীর অধিকাংশ মানুষের জীবিকার উত্স ধান চাষ।আর সেই ধানই যদি পাওয়া না যায় তাদের কপালে হাত। এই জনপদের জনগণ সুদীর্ঘ কাল থেকে প্রকৃতির বৈরী পরিস্তিতির  সাথে লড়াই করে টিকে আছে  ।আবার প্রকৃতিই মমতায়  আগলে রাখে জনপদের জনগনকে।শুষ্ক মৌসুমে মাতামুহুরি নদীর পানিতে ফসল ফলায় কৃষক ।মৌসুমের পরে ও বৃষ্টির পানি  খালবিল  ভরা থাকে। এখনো আছে। কিন্তু সে পানি তোলা যাচ্ছে না। ।ক্ষেতের ধারে খালে পানি আছে ,তবে তা লবণ পানি। যেন মরিচীকা। পোড়া মাতামুহুরি নদী, ডেমুশিয়া খাল সহ সব খালে পানি আছে। সে পানি ছোঁয়া  যাবার  নয়।ধানে দেয়া যাবে না।যদি খালের পানি লবনাক্ত না হতো   বর্যার অনাবৃষ্টিতে খালের জমিয়ে থাকা  পানি দিয়ে চাষাবাদ শেষ করা যেত।কিন্তু ধানের ফসলী জমি লবন পানিতে বন্দী।জলমহাল ইজারা নেয়াতে সুইচ গেট খুলে আরও পানি ভিতরে নিয়ে আসছে স্বার্থান্বেষী মহল।

বাংলাদেশকে  নদীমাতৃক দেশ বলা হয়। দেশ জুড়ে  জালের মতো বিছিয়ে  আছে অসংখ্য  নদনদী, খালবিল, ঝিল জলাশয়।  এই অঞ্চলের মানুষের কাছে  জলাধার সমূহকে প্রকৃতির দান ও বলা যেতে পারে। বাঙ্গালী জাতির ঐতিহাসিক পরিচয় মাছেভাতে বাঙ্গালীআনার প্রধান উত্স খাল বিল ঝিল আর সবুজ ধানক্ষেত।আগেকার দিনে খালে মাছ ধরার সবারই অধিকার ছিল। বিনা বাধায় দিনের প্রয়োজনীয় মাছ শিকার  চিরায়ত ঐতিহ্যের অংশ। কিন্তু আজকের প্রজন্মের কাছে সে ঐতিহ্য শুধু গল্প।বাপ-দাদার দিনের সময়ের মত খালে জাল ফেলা  যায় না।গোসল করার মত নয়।যেখানে জমিয়ে থাকার কথা মিটা পানি।সেখানে ভরিয়ে আছে লবণ পানি।কিন্তু  প্রাকৃতিক দূর্যোগ কিংবা বেড়িবাঁধ ভেঙে  লবনাক্ত পানি ভিতরে আসে নাই। কতিপয় মানুষ নিজেদের স্বার্থে বিবেকহীন ভাবে সুইচ গেট খুলে পানি ঢোকায়েছে।বিগত সপ্তাহে পত্র পত্রিকা সহ বিভিন্ন সামাজিক  মাধ্যমে  পানি ঢোকানোর চিত্র তুলে ধরে ভুক্তভোগী জনসাধারণ।খবরে প্রকাশ, ঢেমুশিয়া জলমহালে লবণের পানি ঢোকাচ্ছে ইজারাদার মহল।সুইস গেট খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে মাতামুহুরি বেষ্টিত সাত ইউনিয়নের খাল বিল জলাশয় লবণ পানিতে পূর্ন হয়ে গেছে। গৃহস্থ মানুষের গৃহপালিত গরু ছাগলের চারণভূমি সহ ফসলি জমিন লবণ পানিতে বন্দী হয়ে যায়। ঢেমুশিয়া ইউনিয়নের একজন বর্গাচাষির সাথে  আলাপ কালে তিনি বলেন, “নিজের জমি নাই। অন্য মানুষের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করি।বৃষ্টির পানিতে ধানের চারা রোপণ করেছি। তাপদ্রাহ এবং অনাবৃষ্টির  কারণে পানিসুকিয়ে গেছে। খালের পানি লবনাক্ত । জানি না কি করি।এই কৃষকের মত মাতামুহুরি বেষ্টিত  সাত ইউনিয়নের সকল কৃষকদের আর্তচিৎকার ও আহাজারি  একই।তিনি আরও বলেন, ” বর্যায় এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে তিন চারদিন বৃষ্টি হলে পানিতে ধানের জমি তলিয়ে যায়।অতিবৃষ্টি কিংবা মাতামুহুরির উজানের পানি নেমে  আসলে ডুুবে যায় ।কারণ বর্ষা মৌসুমে  ইজারাদার মহল সুইচ গেট বন্ধ করে রাখে।পানি নিঃস্কাশন নিয়ে করতে হয় অনেক দৌড় ঝাপ।অতিবৃষ্টিতে পানিবদ্ধতা, অনাবৃষ্টি তে লবণ পানিতে বন্দী,  এই সমস্যা কে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলা যেতে পারে না। অন্য একজন কৃষক বলে উঠেন,” সয়া যাচ্ছে না এই যাতনা,অতিলোভী  অমানুষদের করালগ্রাসে আমরা  অজগরের সামনে পড়া হরিণের মতো শুধু  কাপছি”।

উপকূলীয় প্রতি ঘরে মাছ ধরার জাল ছিল। খালে জাল বিছিয়ে   নিত্যদিনের মাছ আহরণ করতো ।খালের পানিতে শাপলা ফুল ছিল ।কিশোর দল সাতার কেটে খেলা করতো দলবেধে। গ্রামের মহিলারা পর্যন্ত জাল কিংবা ফেনি জাল দিয়ে মাছ ধরতো।এখন খালে নামলেই ব্রিটিশ   সিপাহি  ডান্ডা হাতে তেড়ে আসে।যেন নতুন করে “বর্গী এল দেশে”। জলমহাল এই জনপদের  জনগণের অধিকার। রাজস্বের জন্য  বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে গিয়ে ইজারা প্রদান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকারের কাছে আশা করে না সাধারণ  মানুষ । তাই  মানবিক কারণে এসব ইজারা প্রথা বাতিল চায় মাতামুহুরি উপজেলাবাসী (প্রক্রিয়াধীন)।

উপকূলীয় এসব জায়গা সংস্কার করে বসতি  উপযূক্ত   করার পিছনে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর  অনেক ত্যাগ কষ্টের ইতিহাস জড়িত। দৈত্যদানবের হাতে  রাতারাতি গড়ে উঠে নাই। নগর জীবন  থেকে বিছিন্ন খেটে খাওয়া সরল সহজ মানুষ গুলো নিজেদের শক্ত হাত দিয়ে প্রকৃতির বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সংস্কার করে। আর সংস্কার হতেই  লোভাতুর হায়নাদের দৃষ্টি।দখল হয়ে যায় চকরিয়া সুন্দরবন।এখন দখল হয়ে যাচ্ছে  লোকালয়,মানুষের বাড়ির পিছনের খালটি,নালাটি।প্রশাসনকে  ভুল তথ্য  দিয়ে  বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ  উপেক্ষা করে ইজারা নিয়ে নেয় চক্রটি ।আবার রাজনীতিকে ব্যবসা হিসেবে নেয়া কতিপয় নেতাদের যোগসাজস ইজারা দেওয়ার পিছনে ভূমিকা রাখে।

সাধুবাদ জানাচ্ছি পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাংগঠনিক মাতামুহুরি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এই জনপদের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং নির্ভরযোগ্য নেতা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা ভাইকে।নুরুন্নবী  দালাল  নামীয় একজন ভূমিখেকো চোঁয়ারপাড়ি খালে বাঁধ দিয়ে চিংড়ি ঘের করার অপচেষ্টাকে রুখে দিয়েছেন তিনি। জনস্বার্থে উচ্চ আদালতের রায় রয়েছে যে,”কোন প্রবাহমান খাল লিজ বা বন্দোবস্ত দেয়া যাবে না”।তাই দখল প্রক্রিয়াটি সম্পুর্ন  আইন বিরোধী। চেয়ারম্যান বাবলা সাহেবের  আবেদনের প্রেক্ষিতে উপজেলা প্রশাসন  দখলমুক্ত করে খালটি।(দৈনিক সুপ্রভাত) । তাই এই জনপদের মানুষ আশা করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য ক্ষতিকর যে কোন কাজে জনগণের কন্ঠ হয়ে থাকবেন তিনি। চকরিয়া থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক মাতামুহুরি পত্রিকার বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে গত পহেলা সেপ্টেম্বর চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বাবু জেপি দেওয়ান তার বক্তব্যে ইজারার  শর্ত ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে বিধিমতে ব্যবস্থা সহ উপকূলবাসীর যে কোন স্বার্থে সহযোগিতা করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন  তিনি।

বিশেষজ্ঞ মতামতে,স্বাদু পানির মাটিতে বা নদীতে যখন দীর্ঘমেয়াদি লবনাক্ত পানি ঢুকানো হয়ে থাকে  তখন মাটির জৈবগুন, মাটির উপরে ও ভিতরে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যায়”।তাই মাতামুহুরি নদী বেষ্টিত উপকূল অঞ্চলের মানুষ নিজেদের সুরক্ষা  চায়।জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচার জন্য বেড়িবাঁধ চায়।দখলে যাওয়া নদী খাল উদ্ধার সহ পোড়া মাতামুহুরি নদী,শাখা উপশাখা নিয়ে  সমস্ত  খাল উম্মুক্ত রাখতে হবে। অবৈধ স্বাপনা তুলে দিতে হবে। ফলে বর্যায় জলাবদ্ধতা নিরসন হবে এবং বর্তমান মৌসুমের মত অনাবৃষ্টির কারণে অন্তত কিছুটা হলে ও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে।পিট দেয়ালে টেকে গেছে জনপদের জনগণের । যাতনায় বিদীর্ণ মানুষের মন বিষিয়ে উঠছে। দাবী আদায়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সোচ্চার হচ্ছে দিনকেদিন।সবার স্মরণ রাখা উচিত,কৃষক শ্রমিক শোষিত শ্রেণির মানুষের মুক্তির আজীবন লড়াই চালিয়ে গেছেন বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব । তার ডাকে ছাড়া দিয়ে যার যা কিছু ছিল যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে কৃষক শ্রমিক মেহনতী জনতা।সুতরাং স্বাধীন ভূখণ্ডে নিজেদের অধিকার চায় সাত ইউনিয়নের মানুষ। তাই উপজেলা এবং জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করি।
জয় বাংলা।
———
লেখক -বদরুল ইসলাম বাদল
কলামিস্ট ও সাবেক ছাত্রনেতা
সদস্য, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো ক্যাটাগরি