বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:২৮ অপরাহ্ন

সূরা আদিয়াত

বিবিসি একাত্তর ডেস্ক
  • Update Time : বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০২৪
  • ৯১ Time View

যখন মুসলমানরা ছিল নির্যাতিত ও বিতাড়িত। যুদ্ধাশ্ব বা যুদ্ধের অনুমতি তাদের ছিল না। অথচ সেই সময় আল্লাহ এই সূরাটি নাযিল করে মুসলমানদেরকে সুন্দর ভবিষ্যতের আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন। সূরার শুরুতে যুদ্ধাশ্বের শপথ করে আল্লাহ বলতে চেয়েছেন যে, সেদিনের যুদ্ধাশ্বের ন্যায় আগামী দিনেও যেন মুসলমানরা রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা লাভে প্রয়াসী হয়। অতঃপর মুসলমানরা যদি বস্ত্তগত শক্তি লাভ করে। তাহলে তারা যেন নিরেট বস্ত্তবাদীদের মত অকৃতজ্ঞ ও ধনলিপ্সু জাতিতে পরিণত না হয়। বরং সর্বাবস্থায় আখেরাতে মুক্তি লাভ ও সেখানে জওয়াবদিহিতার ব্যাপারে সতর্ক থাকে। এবং দুনিয়াকে আখেরাত লাভের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে।

আর এই সূরায় যুদ্ধাশ্বের শপথের মাধ্যমে আল্লাহ্ মুসলমানদেরকে সামরিক ও বস্ত্তগত ক্ষমতা অর্জনের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট উত্তম ও অধিকতর প্রিয়; দুর্বল মুমিনের চাইতে’।[মুসলিম হা/২৬৬৪; মিশকাত হা/৫২৯৮]

সূরাটিতে মোটাদাগে দুটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে।

এক। মালিকের প্রতি অনুগত সুদক্ষ সামরিক অশ্বের শপথ করে বলা হয়েছে যে, মানুষ তার পালনকর্তার প্রতি অকৃতজ্ঞ এবং সে ধন-সম্পদের মায়ায় অন্ধ (১-৮ আয়াত)।

দুই। মানুষকে এর মন্দ পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে এবং আখেরাতে জওয়াবদিহিতার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে (৯-১১ আয়াত)।

আল্লাহ পাক সূরার শুরুতে বর্ণিত পরপর পাঁচটি আয়াতে সুপ্রশিক্ষিত, সুদক্ষ ও মালিকের প্রতি অনুগত সামরিক অশ্বের শত্রুপক্ষের উপরে দুঃসাহসিক হামলাকালীন অবস্থা বর্ণনা করেছেন। এবং তাদের শপথ করে বলেছেন যে, মানুষ তার প্রতিপালকের প্রতি একান্তই অকৃতজ্ঞ। অথচ অবলা চতুষ্পদ জন্তু হওয়া সত্ত্বেও সামরিক অশ্বগুলি তাদের মনিবের প্রতি কতই না বিশ্বস্ত ও অনুগত যে, তারা মালিকের হুকুমে জীবন বাজি রেখে শত্রুপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে সৃষ্টিসেরা মানুষ তার সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহর হুকুমের প্রতি আনুগত্যশীল নয় এবং তাঁর দেওয়া অনুগ্রহ সমূহের প্রতি কৃতজ্ঞ নয়।

(১) وَالْعَادِيَاتِ ضَبْحاً
অল্ ‘আ- দিয়া-তি দ্বোয়াব্হান্
‘শপথ ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান অশ্ব সমূহের’।

(২) فَالْمُوْرِيَاتِ قَدْحًا
ফাল্ মূরিয়া-তি ক্বাদ্হান্
‘অতঃপর ক্ষুরাঘাতে অগ্নি বিচ্ছুরক অশ্ব সমূহের (শপথ)’।

(৩) فَالْمُغِيْرَاتِ صُبْحاً
ফাল্মুগীর-তি ছুব্হান্
‘অতঃপর প্রভাতকালে আক্রমণকারী অশ্ব সমূহের (শপথ)’।

(৪) فَأَثَرْنَ بِهِ نَقْعاً
ফাআর্ছানা-বিহী নাক্বআ’ন্।
‘যারা সে সময় ধূলি উৎক্ষেপণ করে’।

(৫) فَوَسَطْنَ بِهِ جَمْعاً
ফাওয়াসাতনা বিহী জ্বাম্‘আন্।
‘অতঃপর যারা শত্রুদলের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে’।

উপরোক্ত পাঁচটি আয়াতে আল্লাহ পাক সুদক্ষ ও দুঃসাহসী সামরিক অশ্বের যে বৈশিষ্ট্যগুলি বর্ণনা করেছেন, তা একত্রিত করে নিম্নরূপে বলা যায় :-
‘শপথ ঐ অশ্বসমূহের। ভীষণ বেগে দৌড়ানোর সময় যাদের ক্ষুরাঘাতে অগ্নি বিচ্ছুরিত হয়। এবং প্রভাতকালে হামলা করে শত্রুব্যুহের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। এ সময় ঘনঘোর যুদ্ধের কারণে সকালের ঠান্ডা আবহাওয়াতেও আকাশে ধূলি উৎক্ষিপ্ত হয়’।

(৬) إِنَّ الْإِنْسَانَ لِرَبِّهِ لَكَنُوْدٌ
ইন্নাল্ ইন্সা-না লিরব্বিহী লাকানূদ্।
‘নিশ্চয় মানুষ তার পালনকর্তার প্রতি অকৃতজ্ঞ’।

এটি উপরে বর্ণিত শপথগুলির জওয়াব হিসাবে এসেছে। অর্থাৎ মনিবের প্রতি অনুগত সুদক্ষ যুদ্ধাশ্বের শপথ করে বলছি, নিশ্চয়ই মানুষ তার মালিকের প্রতি অকৃতজ্ঞ। অতএব অবাধ্য হওয়াটাই যেন মানুষের স্বভাব। প্রশ্ন হতে পারে যে, মানুষকে যখন দোষযুক্ত করেই সৃষ্টি করা হয়েছে। তখন সে দোষ করলে তাকে দোষী বলা হবে কেন? জওয়াব এই যে, এখানে মানব স্বভাবে নিহিত মন্দ উপকরণটার কথাই কেবল বলা হয়েছে। কিন্ত ভাল উপকরণটার কথা অন্যত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। যেমন, ‘তবে মুমিনগণ ব্যতীত’। ‘যারা নিয়মিতভাবে নামাজ আদায় করে’। ‘যাদের ধন-সম্পদে নির্ধারিত হক রয়েছে,’ ‘প্রার্থী ও বঞ্চিতদের জন্য’। ‘যারা বিচার দিবসকে সত্য বলে বিশ্বাস করে’। ‘যারা তাদের প্রতিপালকের শাস্তির ভয়ে ভীত থাকে’ (সূরা মা’য়ারিজ ৭০/২২-২৭)। মানুষের স্বভাবে ভাল ও মন্দ দু’টি দিকই রয়েছে। আর উভয় প্রবণতাকে মানুষের ইচ্ছাধীন করে দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাকে সুপথ প্রদর্শন করেছি। এক্ষণে সে কৃতজ্ঞ হতে পারে কিংবা অকৃতজ্ঞ হতে পারে’ (সূরা দাহর ৭৬/৩)। তাফসীরকারীদের মতে ‘আল্লাহর নেয়ামতসমূহকে অস্বীকার করাও আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা’।

(৭) وَإِنَّهُ عَلَى ذَلِكَ لَشَهِيْدٌ
অইন্নাহূ ‘আলা-যা-লিকা লাশাহীদ্।
‘এবং সে নিজেই এ বিষয়ে সাক্ষী’।

অর্থাৎ মানুষ যে আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ, তার কথা ও কর্মই তার জ্বলন্ত সাক্ষী। বান্দা নিজেও যেমন তার নিজের অকৃতজ্ঞতা সম্পর্কে অবহিত। আল্লাহ তেমনি সম্যক অবগত। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, ‘যেদিন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে তাদের জবান। তাদের হাত ও তাদের পা তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে’ (সূরা নূর ২৪/২৪)। এ ব্যাপারে বান্দা যেমন সাক্ষী, আল্লাহ তেমনি সাক্ষী।

(৮) وَإِنَّهُ لِحُبِّ الْخَيْرِ لَشَدِيْدٌ
অইন্নাহূ লিহুব্বিল্ খইরি লাশাদীদ্।
‘নিশ্চয়ই সে ধন-সম্পদের মায়ায় অন্ধ’।

এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক- সে ধনলিপ্সায় অন্ধ। দুই- ধনলিপ্সার কারণে সে প্রচন্ড কৃপণ’ (ইবনে কাসীর)। কাফির, মুনাফিক ও বস্ত্তবাদীদের একমাত্র লক্ষ্য থাকে মাল উপার্জন। তারা মালের প্রতি হয় প্রচন্ড আসক্ত ও দারুন কৃপণ। পক্ষান্তরে মুমিনরা মালকে আল্লাহর রাহে ব্যয় করার প্রতি থাকে সর্বদা আগ্রহশীল ও উদার।

(৯) أَفَلاَ يَعْلَمُ إِذَا بُعْثِرَ مَا فِيْ الْقُبُوْرِ
আফালা- ইয়া’লামু ইযা-বু’ছিরা মা-ফিল্ কুবুরি।
‘সে কি জানে না, যখন কবরে যা আছে তা উত্থিত হবে’।

অর্থ্যৎ, তবে কি মানুষ জানে না? সে কি তার স্বাভাবিক জ্ঞান দিয়েও বুঝতে পারে না? সে যেভাবে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। অনুরূপভাবে সে কি তার কবর থেকে জেগে উঠবে না? যেমনটা আল্লাহ বলেন, ‘যখন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, তখনই তারা কবর থেকে উঠে তাদের প্রতিপালকের দিকে ছুটে আসবে’ (সূরা ইয়াসীন ৩৬/৫১)। পূর্বের আয়াতগুলিতে মানুষের অকৃতজ্ঞতা ও প্রচন্ড ধনলিপ্সার কথা বর্ণনার পর এখানে মানুষকে দুনিয়াত্যাগ ও আখেরাতে জওয়াবদিহিতার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে আল্লাহ বলছেন, মানুষ কি জানে না যে, তাকে কবর থেকে পুনরুত্থিত হতে হবে? এর মাধ্যমে ক্বিয়ামত যে অবশ্যম্ভাবী, সেকথা বুঝানো হয়েছে।

(১০) وَحُصِّلَ مَا فِي الصُّدُوْرِ
অহুছছিলা মা-ফিছ্ ছুদূরি।
‘এবং বুকের মধ্যে যা লুকানো ছিল সব প্রকাশিত হবে’।

অর্থ্যাৎ তাদের অন্তরে যেসব বিষয় লুকানো ছিল, সেদিন সব প্রকাশিত হবে (ইবনে কাসীর)। দুনিয়াতে মানুষের বাহ্যিক দিকটাই প্রকাশিত হয়ে থাকে। এমনকি দুনিয়াতে মুনাফিকও খাঁটি মুসলিমের মতই আচরণ করে। কিন্তু আখেরাতে মানুষের মনের খবর সব প্রকাশ পেয়ে যাবে। আর তার উপরেই তার কর্মফল নির্ধারিত হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন গোপন বিষয় সমূহ পরীক্ষিত হবে’। (সূরা তারিক্ব ৮৬/১০)।

(১১) إِنَّ رَبَّهُمْ بِهِمْ يَوْمَئِذٍ لَّخَبِيْرٌ
ইন্না রব্বাহুম্ বিহিম্ ইয়াওমায়িযিল লাখর্বী।
‘নিশ্চয়ই তাদের প্রতিপালক সেদিন তাদের কি হবে, সে বিষয়ে সম্যক অবগত’।

বস্ত্ততঃ لَخَبِيْرٌ বলার মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ বান্দার গোপন ও প্রকাশ্য সকল বিষয়ই জানেন। আর সেদিন তিনি তার যথার্থ প্রতিফল দান করবেন। কারো প্রতিই সামান্যতম যুলুম করা হবে না।

সারকথা :
সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করার পরেও মানুষকে অবশেষে কবরে আশ্রয় নিতেই হবে। অতঃপর পরকালে সবকিছুর জওয়াবদিহি করতেই হবে। আর এ বিষয়েই কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে অত্র সূরাতে।

Please Share This Post in Your Social Media

আরো ক্যাটাগরি
© All rights reserved © 2024 bbcekottor.com
Technical suported by Mohammad Iliych