বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ০৯:২০ অপরাহ্ন

সূরা ইনশিরাহ

বিবিসি একাত্তর ডেস্ক
  • Update Time : মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০২৪
  • ২১৭ Time View

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে সূরা ইনশিরাহতে স্বস্তির সুসংবাদ দিয়ে বলেছেন- “অবশ্যই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে। অবশ্যই কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি।” আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরপর দু’বার একই কথা পুনরাবৃত্তি করে গ্যারান্টি দিয়ে বলছেন যে, আমাদের কষ্টের অবস্থা কখনই স্থায়ী হয় না। রাতের আঁধারের পরেই আসে দিনের আলো। আর এটাই হচ্ছে সূরা ইনশিরাহর মূল ম্যাসেজ।

আসলে আমাদের জীবনটা যে কষ্ট এবং স্বস্তির একটি চক্র। সেটাও এই সূরার আয়াত দুটিতে বলা হয়েছে। আমরা যেন মনে না করি যে, ‘আমি তো একজন মুসলিম। মুসলিমরা কেন বিপদে পড়বে?’ এভাবেই মুসলিম সমাজে আমরা চার ধরণের মানুষকে দেখতে পাই— ১) মু’মিন মুসলিম, যার আল্লাহর উপর ঈমান ও পুরোপুরি আস্থা ভরসা আছে; ২) নিয়মিত মুসলিম, কিন্তু ঈমানে ফাটল আছে; ৩) নামে মুসলিম, কিন্তু কাজে যে কী সে নিজেও জানে না; এবং ৪) বাইরে মুসলিম, কিন্তু ভেতরে ইসলাম বিদ্বেষী। আর এদের সবার জন্যই আল্লাহ নানা ধরণের পরীক্ষা দেন। সেই পরীক্ষাগুলো অনেক সময় ভীষণ কষ্টেরও হয়। কিন্তু এই পরীক্ষাগুলোর মধ্য দিয়েই তাদের ঈমানের যাচাই হয়ে যায়। তাদের ভেতরে আসলে কী আছে, তাও বেরিয়ে আসে। যেমনটা আল্লাহ বলেন, “মানুষ কি ভেবেছে যে, তাদেরকে কোনো পরীক্ষা না করেই ছেড়ে দেওয়া হবে, কারণ তারা মুখে বলছে, ‘আমরা তো মুমিন!” [সূরা আনকাবুত:২]

এই সূরায় তাই আল্লাহ গ্যারান্টি দিয়েছেন যে, প্রতিটি কষ্টের সাথে জীবনের অন্য কোনো না কোনো দিকে কমপক্ষে দুটো স্বস্তি আসবেই। দেখবেন জীবনে একটা কষ্ট এসেছে। কিন্তু অন্য দুটো দিকে ভালো কিছু না কিছু হয়েছেই। যাদের আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাস এবং আস্থা আছে। তারা বিপদের মধ্যে ডুবে থেকেও দেখতে পান যে, আল্লাহ তাকে কতভাবে সাহায্য করছেন সেই বিপদ পার করার জন্য। কিন্তু যাদের ঈমান নড়বড়ে। আল্লাহর উপর আস্থা নেই। তারা বিপদে পড়ে চারিদিকে শুধু অন্ধকারই দেখতে থাকেন।

শুধু বর্তমান সময়েই নয়, দুনিয়ার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই এই একইভাবে এটা চলছে। যখনই কেউ তাওহীদের একত্ববাদের ডাক দিবে, তখনই সকল ইসলাম বিদ্বেষীরা একযোগে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। রাসূল (সাঃ) এর যুগে তো বটেই। আজকের সমাজেও এটা প্রকটভাবে লক্ষ্যনীয় যে, যখনই আপনি আল্লাহর হুকুম ও রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রদর্শিত পথে জীবন পরিচালনা করবেন। তখনই হাজারো ঝড়-ঝাপটা, প্রতিকূলতা ও বাধা বিপত্তির মুখে পড়বেন। দাড়ি, টুপি, হিজাব কিংবা টাখনুর উপর কাপড় পড়া থেকে শুরু করে। ঈমান, আমল, ইবাদত। এমনকি ইসলামের অধ্যায়ন ও সুন্নাহর অনুসরণ করা পর্যন্ত। সর্বত্র ইসলাম বিদ্বেষীদের নানাবিধ প্রতিরোধ। বহুবিধ হেয় প্রতিপন্নতায় আপনার অন্তরকে বিঁষিয়ে তুলবে।

এই অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য প্রশস্ত অন্তর দরকার। দিনের পর দিন এত অন্যায়, অবিচার সহ্য করতে না পেরে এভাবে একসময় ইসলামের পথ থেকে অনেকেই ঝরে যায়। একারণে যাদের অন্তরকে আল্লাহ প্রশস্ত করে দেন, শুধু তারাই পারে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ইসলামের পথে অবিচল থাকতে।

কাজেই যাকে আল্লাহ সঠিক পথ দেখানোর ইচ্ছা করেন, তার অন্তরকে তিনি ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন। [আল-আন‘আম ১২৫]

অন্তরের প্রশস্ততা না থাকলে ইসলামের নিয়মকানুন মেনে চলাও সবসময় সম্ভব হয় না। তখন মানুষ ইসলাম নিয়ে নানা ধরণের সন্দেহে ভোগে, যেমন—
“সুদ আর ব্যবসায় লাভ তো একই কথা। কেন ইসলামে সুদ হারাম?”
“মেয়েদেরকে কেন বাচ্চা জন্ম দেওয়ার কষ্ট করতে হবে? ছেলেরা বাচ্চা জন্ম দেয় না কেন?” ইত্যাদি…

কিন্তু যখন অন্তরের প্রশস্ততা চলে আসে, তখন আল্লাহর নির্দেশ মানতে আর কোনো সমস্যা থাকে না। আল্লাহ যাকে ইসলাম বোঝার সামর্থ্য দিয়েছেন, এজন্য সে কৃতজ্ঞতায় বিনত হয়। তখন তার প্রতিটি সিজদা হয়ে যায় কৃতজ্ঞতায় ভরা, বিনম্র, শ্রদ্ধার সিজদা।

হ্যাঁ, কষ্টের অবস্থা স্থায়ী হয় না। রাতের আঁধারের পরেই আসে দিনের আলো।-— এটাই হচ্ছে সূরা ইনশিরাহর মূল ম্যাসেজ। দেখুন, কিভাবে?

সূরা ইনশিরাহ যখন নাযিল হয় তখন সমগ্র পৃথিবীতে মুসলিমের সংখ্যা প্রায় ৫০ জনের মত ছিল। অর্থাৎ চারপাশে অবিশ্বাসী আর শত্রুতা-হিংসায় ভরপুর হিংস্র পাশবিক একটা অন্ধকার সমাজ। এর মাঝে দাঁড়িয়ে রাসূল (সাঃ) তাওহীদের ডাক দিলেন। ঐ সময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ)কে চরমতম অবর্ণনীয় এক দুঃখ, কষ্ট, নির্যাতন, নিপীড়ন, আর হতাশার মাঝ দিয়ে তাওহিদের প্রচার করতে হয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরও রাসূল (সাঃ) চাইলে স্রোতের অনুকূলে চলে গিয়ে দুনিয়ার সাম্রাজ্য ও বিলাসী জীবনকে বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু না, বরং তিনি আল্লাহর একত্ববাদের পথপ্রদর্শক রুপে ঈমানের প্রশ্নে অটল থেকে স্রোতের ১৮০ ডিগ্রীর বিপরীতে থেকে পুরো স্রোতটাকেই ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন।

আর বিনিময়ে আল্লাহ উনাকে যা দিলেন, তা হলো। আল্লাহ নিজেই যেটা বলছেন-
“এবং আমি আপনার জন্য আপনার খ্যাতিকে সুউচ্চ করেছি”- (৯৪;৪)

আর সেটা কিভাবে -—
*দুনিয়ায় প্রতিদিন সবচেয়ে বেশী উচ্চারিত নাম, সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয় নাম, মুহাম্মাদ (সাঃ)।
*দিনে পাঁচবার বিশ্বের প্রতিটা মাসজিদে উচ্চস্বরে আল্লাহর সাথেই যে নামটা উচ্চারিত হয় সেটা হল মুহাম্মাদ (সাঃ)।
*যেখানে আল্লাহর নাম আসে সেখানে মুহাম্মাদ (সাঃ)এর নাম আসে।
*মুহাম্মাদ (সাঃ) এর রেখে যাওয়া আল কুরআন আজও অবিকৃত অবস্থায় আছে।
*আখিরাতেও মুহাম্মাদ (সাঃ) সর্বোচ্চ মর্যাদা পাবেন।
*আল্লাহ মুহাম্মাদ (সাঃ) কে আল কাউসার দান করেছেন।
*সকল মুমিনের অন্তরে রয়েছে উনার প্রতি নিখাদ ভালোবাসা। মস্তিস্কে রয়েছে উনার মহত্ব, বড়ত্ব, ভালোবাসার চিন্তা।
*পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নাম এবং গুণ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা হয়েছে।
*ফিরিশতাদের মাঝেও মুহাম্মাদ (সাঃ)এর প্রতি সালাম ও প্রশংসাযুক্ত নাম উল্লেখ করা হয়।
*মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আনুগত্যকেও মহান আল্লাহ নিজের আনুগত্যরূপে শামিল করেছেন এবং নিজের আদেশ পালন করার সাথে সাথে তাঁর আদেশও পালন করতে মানব সম্প্রদায়কে নির্দেশ দিয়েছেন।

এই সূরায় ১ম অংশে (আয়াত ১-৬) আল্লাহ মুহাম্মাদ (সাঃ) এর প্রতি যে অনুগ্রহ ও নিয়ামত দান করেছেন তা বর্ননা করেছেন। এবং ২য় অংশে (আয়াত ৭-৮) আল্লাহর দেয়া নিয়ামত ও অনুগ্রহ পাওয়ার পর প্রতিদান দেওয়ার জন্য মুহাম্মাদ (সাঃ) কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এবার আসুন, সূরাটি অর্থ সহ পড়ে নেই-

১। أَلَمْ نَشْرَحْ لَكَ صَدْرَكَ
“আলাম্ নাশ্রাহ্ লাকা ছোয়াদ্রাক”
‘আমি কি আপনার বক্ষকে প্রশস্ত করে দিইনি’?

এই সূরায় মহানবী (সাঃ)-এর প্রতি তিনটি নিয়ামত বা অনুগ্রহের কথা আলোচনা হয়েছে। তার মধ্যে উনার ‘বক্ষ প্রশস্ত’ করে দেওয়া হল প্রথম অনুগ্রহ। এর অর্থ হল, বক্ষ আলোকিত এবং উদার হওয়া; যাতে সত্য স্পষ্ট হয়ে যায় এবং তার জন্য হৃদয় সংকুলান হয়। একই অর্থে কুরআন কারীমের এই আয়াতওঃ ‘‘আল্লাহ যাকে পথ-প্রদর্শন করতে চান, তার বক্ষকে ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন।’’ (সূরা আনআম ১২৫ আয়াত)।

এই ‘বক্ষ প্রশস্ত’-এর অর্থে সেই ‘বক্ষ বিদীর্ণ’ (সিনাচাক)ও এসে যায়; যা বিশুদ্ধ হাদীসানুযায়ী নবী (সাঃ)-এর দু’-দু’ বার ঘটেছিলঃ একবার বাল্যকালে যখন তাঁর বয়স ৪ বছর। আর একবার তা মি’রাজের সময় ঘটেছিল।

২। وَوَضَعْنَا عَنكَ وِزْرَكَ
“ওয়া ওয়াদ্বানা আ’নঁকা উইঝরাক”
‘আমি আপনার উপর হতে অপসারণ করেছি আপনার সেই ভার;’

এই ভার বা বোঝা নবুঅতের পূর্বে তাঁর চল্লিশ বছর বয়সকালের সাথে সম্পৃক্ত। এই জীবনে যদিও আল্লাহ তাঁকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন; সুতরাং তিনি কোন মূর্তির সামনে মাথা ঝুঁকাননি, কখনো মদ্য পান করেননি এবং এ ছাড়া অন্যান্য পাপাচরণ থেকেও তিনি সুদূরে ছিলেন। তবুও প্রসিদ্ধ অর্থে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য সম্পর্কে তিনি জানতেন না; আর না তিনি তা করেছেন। এই জন্য বিগত চল্লিশ বছরে ইবাদত ও আনুগত্য না করার বোঝা তাঁর হৃদয় ও মস্তিষ্কে সওয়ার ছিল; যা সত্যিকারে কোন বোঝা ছিল না। কিন্তু তাঁর অনুভূতি ও উপলব্ধি তা বোঝা বানিয়ে রেখেছিল। আল্লাহ তাআলা তাঁর সেই বোঝাকে নামিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করে তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করলেন।

কোন কোন আলেমগণ বলেন, এটা নবুঅতের বোঝা ছিল যেটাকে আল্লাহ হালকা করে দিলেন। অর্থাৎ, আল্লাহ এই রাস্তায় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ বৃদ্ধি এবং দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে সরলতা সৃষ্টি করলেন।

৩। الَّذِي أَنقَضَ ظَهْرَكَ
“আল্লাজী আনঁ ক্বাদ্বা জ্বাহরাক”
‘যা আপনার পিঠকে করে রেখেছিল ভারাক্রান্ত।’

৪। وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ
“ওরাফা’না লাকা জিকরাক”
‘আর আমি আপনার খ্যাতিকে সমুচ্চ করেছি।’

৫। فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا
“ফাইন্নাঁ মা‘আল্ উসরি য়ূসরান”
‘অতএব কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি’

৬। إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا
“ইন্না মা‘আল্ উসরি য়ূসরান”
‘নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।’

এ হল নবী (সাঃ) ও উনার সাহাবাগণের জন্য শুভসংবাদ যে, তোমরা ইসলামের পথে যা কিছু দুঃখ-কষ্ট সহ্য করছ এ ব্যাপারে চিন্তিত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। যেহেতু এর পরেই আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য অবসর ও স্বস্তি এনে দেবেন।

৭। فَإِذَا فَرَغْتَ فَانصَبْ
“ফাইজা ফারাগতা ফানছব”
‘অতএব যখনই অবসর পাও, তখনই (আল্লাহর ইবাদতে) সচেষ্ট হও।’

অর্থাৎ, যখনই অবসর পাও তখনই ইবাদতের জন্য সচেষ্ট হও। অথবা এত বেশী আল্লাহর ইবাদত কর, যাতে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়।

৮। وَإِلَى رَبِّكَ فَارْغَبْ
“ওয়াইলা রাববিকা ফারগাব”
‘আর আপনার প্রতিপালকের প্রতিই মনোনিবেশ করুন।’

অর্থাৎ, তাঁর কাছেই তুমি জান্নাতের আশা রাখ। তাঁর কাছেই তুমি নিজের প্রয়োজন ভিক্ষা কর এবং সর্ববিষয়ে তাঁরই উপর নির্ভর কর ও ভরসা রাখ।

Please Share This Post in Your Social Media

আরো ক্যাটাগরি
© All rights reserved © 2024 bbcekottor.com
Technical suported by Mohammad Iliych