ক্বারিয়াহ্ শব্দের অর্থ চূর্ণবিচূর্ণকারী। এখানে এ শব্দের মাধ্যমে কিয়ামতের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কিয়ামতের দিন পৃথিবী ও সব গ্রহ-উপগ্রহসহ বিশ্বের সবকিছুকে চূর্ণ-বিচূর্ণ বা লন্ডভণ্ড করে দেবে। সূরার শুরুতে মানুষকে একটি “মহাপ্রলয়!” বলে সতর্ক করা হয়েছে। ‘কী সেই মহাপ্রলয়? আপনি কি জানেন সেই মহাপ্রলয়টি কী?’ এভাবে একটি ভয়াবহ ঘটনা অনুষ্ঠিত হবার খবর শোনার জন্য প্রস্তুত করার পর, দুটি বাক্যে কিয়ামতের নক্শা এঁকে দেয়া হয়েছে।
বলা হয়েছে, সেদিন লোকেরা আতংকগ্রস্ত হয়ে এমনভাবে চারদিকে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকবে যেমন প্রদীপের আলোর চারদিকে পতংগরা নির্লিপ্তভাবে ছুটাছুটি করতে থাকে। পাহাড়গুলো সমূলে উৎপাটিত হয়ে স্থানচ্যূত হবে। তাদের বাঁধন থাকবে না। তারা তখন হয়ে যাবে ধূনা পশমের মতো। তারপর বলা হয়েছে, আখেরাতে লোকদের কাজের হিসেব নিকেশ করার জন্য যখন আল্লাহর আদালত কায়েম হবে। তখন কারো সৎ কাজ তার অসৎকাজের চাইতে ওজনে ভারী হবে। এবং কারো সৎকাজ তার অসৎকাজের চাইতে ওজনে হালকা হবে। আর তখন এর ভিত্তিতেই সেখানে ফায়সালা হবে। প্রথম ধরনের লোকেরা আরামের ও সুখের জীবন লাভ করে আনন্দিত হবে। আর দ্বিতীয় ধরনের লোকদেরকে এমন গভীর গর্তের মধ্যে ফেলে দেয়া হবে যেগুলো থাকবে শুধু আগুনে ভরা।
আসুন এই সুরাটি পড়ে নেয়া যাক:-
অসীম দয়াময় ও অনন্ত করুণাময় আল্লাহর নামে
(১) الْقَارِعَةُ
আল্ক্ব-রি‘আতু
চূর্ণ-বিচূর্ণকারী মহাপ্রলয়,
(২) مَا الْقَارِعَةُ
মাল্ক্ব-রি‘আহ্
চূর্ণ-বিচূর্ণকারী মহাপ্রলয় কি?
(৩) وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْقَارِعَةُ
অমা-য় আদ্র-কা মাল্ক্ব-রি‘আহ্
কি তোমাকে চূর্ণ-বিচূর্ণকারী মহাপ্রলয় সম্বন্ধে অবহিত করল?
(৪) يَوْمَ يَكُونُ النَّاسُ كَالْفَرَاشِ الْمَبْثُوثِ
ইয়াওমা ইয়াকূনুন্না-সু কাল্ফার শিল্ মাব্ছূছি।
সেদিন মানুষ বিক্ষিপ্ত পতঙ্গের মত হবে।
এখানে মানুষকে পতঙ্গের সঙ্গে তুলনা করার বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। পতঙ্গরা সাধারণত পাগলের মত আগুন বা আলোর মধ্যে এসে পড়ে এবং পুড়ে যায়। পাপী মানুষেরাও ঠিক একইভাবে নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করছে। কিয়ামতের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞে মানুষ হতবাক ও বিচলিত হয়ে দিশাহারা হয়ে পড়বে।
(৫) وَتَكُونُ الْجِبَالُ كَالْعِهْنِ الْمَنْفُوشِ
অতাকূনুল্ জ্বিবা-লু কাল্ ই’হ্নিল্ মান্ফূশ্।
এবং পাহাড়গুলো তুলার পেঁজার মত উড়তে থাকবে।
পুনরুত্থান বা কিয়ামত দিবসের প্রাক্কালে পাহাড়-পর্বতগুলো প্রবল ভূকম্পন ও আলোড়নের মাধ্যমে ধুলো-বালির মত ছিন্ন-ভিন্ন হবে এবং ধূনিত রঙ্গীন পশম বা তুলার মত হয়ে উড়তে থাকবে। শেষ পর্যন্ত এসবই পুরোপুরি ধ্বংস বা বিলীন হয়ে যাবে।
(৬) فَأَمَّا مَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ
ফাআম্মা-মান্ ছাকুলাত্ মাওয়া-যীনুহূ।
সেদিন যার নেকি বা কল্যাণের পাল্লা ভারী হবে,
আমলের ওজন ও তার হালকা এবং ভারী হওয়ার প্রেক্ষিতে জাহান্নাম অথবা জান্নাত লাভের বিষয় আলোচিত হয়েছে। বিভিন্ন হাদীস ও আয়াতের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে জানা যায়, আমলের ওজন সম্ভবতঃ দু’বার হবে। প্রথমতঃ ওজন করে মুমিন ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা হবে। মুমিনের পাল্লা ভারী ও কাফেরের পাল্লা হালকা হবে। এরপর মুমিনদের মধ্যে সৎকর্ম ও অসৎকর্মের পার্থক্য বিধানের জন্যে হবে দ্বিতীয় দফা ওজন করা হবে। এ সূরায় বাহ্যতঃ প্রথম ওজন বোঝানো হয়েছে, যাতে প্রত্যেক মুমিনের পাল্লা ঈমানের অভাবে হালকা হবে, সে যদিও কিছু সৎকর্ম করে থাকে। যার আমল আন্তরিকতাপূর্ণ ও সুন্নতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সংখ্যায় কম হলেও তার আমলের ওজন বেশি হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সংখ্যায় তো নামায, রোযা, সদকা-যাক্বাত, হজ্জ অনেক করে। কিন্তু আন্তরিকতা ও সুন্নতের সাথে সামঞ্জস্য কম। তার আমলের ওজন কম হবে।[তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন]
মিজান বা পাল্লা শব্দের ব্যবহারও এখানে তাৎপর্যপূর্ণ। পরকালে মানুষের বিচার হবে পুরোপুরি ন্যায়বিচার-ভিত্তিক। যেমন, জন্মসূত্রে ধনী ও দরিদ্র ব্যক্তি এবং জন্মান্ধ ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী মানুষের বিচার হবে তাদের অবস্থার অনুপাতে। তাই এটা স্পষ্ট এ সুরায় পাল্লার যে পরিমাপের কথা বলা হয়েছে তার অন্যতম অর্থ মহান আল্লাহর ন্যায়বিচার।
(৭) فَهُوَ فِي عِيشَةٍ رَاضِيَةٍ
ফাহুওয়া ফী ঈ’শার্তি রা-দ্বিয়াহ্
সে মনঃপুত ভোগ-বিলাসে থাকবে।
(৮) وَأَمَّا مَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ
অআম্মা- মান্ খাফ্ফাত্ মাওয়া-যীনুহূ।
কিন্তু যার পাল্লা হালকা হবে,
(৯) فَأُمُّهُ هَاوِيَةٌ
ফাউম্মুহূ হা-ওয়িয়াহ্।
তার স্থান হবে ‘হাবিয়া।’
(১০) وَمَا أَدْرَاكَ مَا هِيَهْ
অমা য় আদ্রা-কা মা-হিয়াহ্
আর তুমি জান হাবিয়া কী?
(১১) نَارٌ حَامِيَةٌ
না-রুন্ হা-মিয়াহ্।
তা উত্তপ্ত অগ্নি।
পবিত্র কোরআনের অন্য অনেক সুরার মতই সুরা ক্বারিয়াহ্তেও পরকালে মানুষ যে দুটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত হবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। এ দুই শ্রেণী হল বিশ্বাসী বা সৎকর্মশীল। এবং অবিশ্বাসী ও পাপী। যারা ঈমানদার ও সৎ কাজ করবে এবং যাদের সৎ কাজের পাল্লা মন্দ কাজের চেয়ে ভারি হবে তারা বেহেশতে যাবে। একদিকে সৎকর্মশীলরা থাকবে বেহেশতের অপার সুখে। বেহেশতবাসীরা থাকবে পুরোপুরি সন্তুষ্ট। বেহেশতের বৈশিষ্ট্যই হল এমন। কিন্তু দুনিয়ার জীবনে মানুষ যতই প্রাচুর্য, নিরাপত্তা ও সুখের অধিকারী হোক না কেন তা নানা অসুখ বা অসন্তুষ্টি থেকে মুক্ত নয়। নিরেট ও পরিপূর্ণ সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কেবল পরকালের জীবনেই ভোগ করা সম্ভব।
অন্যদিকে জাহান্নামের শাস্তিও অকল্পনীয় মাত্রায় কঠিন ও অসহনীয় হবে। যাদের সৎকর্ম ও বিশ্বাসের পাল্লা হাল্কা হবে। তারাই হবে জাহান্নামের বা দোযখের অধিবাসী। হাবিয়া হচ্ছে অন্যতম দোযখ বা জাহান্নাম। দুনিয়ার আগুনের তুলনায় অকল্পনীয় মাত্রায় বেশি প্রজ্জ্বলিত ও উত্তপ্ত আগুনের অসহনীয় দহন সহ্য করতে হবে জাহান্নামের অধিবাসীদের।
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে পরকালীন সাফল্য অর্জনের সৌভাগ্য দান করুন।